বুধবার । ৩রা ডিসেম্বর, ২০২৫ । ১৮ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩২
বিজয়ের স্মৃতিকথা

পাকিস্তানি সেনাদের হাতে নির্যাতিত খুলনার সাংবাদিক আজীজ খান

কাজী মোতাহার রহমান

মার্চ ১৯৭১। বিশ্ববাসী তাকিয়ে ছিল পাকিস্তান নামক ভূ-খণ্ডের দিকে। পহেলা মার্চ পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জেঃ ইয়াহিয়া খান বেতার ও টেলিভিশনে জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ দেন। প্রেসিডেন্ট এ ভাষণে ৩ মার্চ জাতীয় সংসদের অধিবেশন স্থগিতের ঘোষণা করেন। পূর্ব পাকিস্তানের ১৯ জেলার মানুষ ফুঁসে ওঠে।

তখন এ সংগঠনের নেতৃত্বে ছিলেন আব্দুল মজিদ, রফিকুল ইসলাম, আব্দুর রশিদ, অধ্যাপক খালেদ রশীদ, কামরুজ্জামান লিচু, হাফিজুর রহমান ভূঁইয়া ও আজিজুর রহমান (একাত্তরে জেলে আটক ছিলেন)। রূপসা অঞ্চলে নেতৃত্বে ছিলেন খায়েরুজ্জামান ও জীবন মূখার্জী। ডুমুরিয়া, শোভনা, রূপসা থানার ডোবা ও তালা থানার খলিশখালী ঘাঁটি অঞ্চল হিসেবে গড়ে ওঠে। এদের একজন আজীজ খান। তিনি খুলনা শহরের শেরে বাংলা রোড¯ ময়লাপোতায় পরিবার পরিজন নিয়ে বসবাস করতেন। সমাজ পরিবর্তনের উদ্দেশ্যে জনমত সৃষ্টির লক্ষ্যে খুলনার সাপ্তাহিক আওয়াজ পত্রিকায় উপ-সম্পাদকীয় লিখতেন। এই পত্রিকার মালিক ছিল মুসলিম লীগ সমর্থক। পত্রিকার দপ্তর ফারাজী পাড়ায়। আজীজ খানের লেখনিতে পশ্চিম পাকিস্তানের সাথে পূর্ব পাকিস্তানের অর্থনৈতিক বৈষম্য, শোষণ ও বাঙালির বঞ্চনার চিত্র ফুটে উঠত। লেখনিতে স্থান পেত পশ্চিম পাকিস্তানের ২০ পরিবার আইন সংগত ডাকাতির টাকা দু’হাতে লুট করে নিয়ে যাচ্ছে। দাউদ কর্পোরেশন, আদমজী, বাওয়ানী গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজ, ইস্পাহানী, নিশাত গ্রুপ, আমিন এজেন্সিস, গহওর আইয়ুব, সায়গাল, ইউসুফ হারুন প্রভৃতি ২০ পরিবারের হাতে পাকিস্তানের সমুদয় সম্পদের শতকরা ৬৫ ভাগ জমা রয়েছে।

পারিবারিক সূত্রের দাবি ১৯৭১ সালের পঁচিশ মার্চ রাত ৮টায় পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জেঃ ইয়াহিয়া খান জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ দেন। ভাষণে তিনি শেখ মুজিবুর রহমানের ওপর দোষ চাপান। তিনি সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা মুজিবকে উদ্দেশ্য করে বলেন, “This crime cannot go unpunished”। শহরের অধিকাংশ মানুষের কাছে স্পষ্ট হয় যুদ্ধ অনিবার্য। প্রেসিডেন্টের ভাষণ শেষ হওয়ার কিছুক্ষণ পর পাকিস্তানি সেনা ও পুলিশ আজীজ খানকে তার ময়লাপোতা এলাকার বাসা থেকে গ্রেপ্তার করে। এ সময় তাদের সাথে মুখোশ পরা কয়েকজন অবাঙালি ছিল।

গোয়েন্দা সংস্থার রিপোর্ট ছিল তিনি আব্দুল হকের নেতৃত্বাধীন কমিউনিস্ট পার্টির সাথে সম্পৃক্ত। তাকে দিনে খুলনা সার্কিট হাউসে, রাতে সার্কিট হাউসের পার্শ্ববর্তী ফায়ার ব্রিগেড রোডস্থ হাসান সাহেবের মালিকানাধীন হোটেল শাহীন ও ফরেস্ট অফিসে রাখা হতো। সার্কিট হাউজে পাকিস্তান সেনা সদর দপ্তরের অধিনায়ক ছিলেন লেঃ কর্নেল শামস উল জামান। সাত দিন পর তাকে যশোর সেনানিবাসে পাঠানো হয়। গোয়েন্দা সংস্থার কাছে তথ্য এবং সংবাদপত্রে আজীজ খানের উপ-সম্পাদকীয়’র ভিত্তিতে নানা বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হতো। যশোর সেনানিবাসে সামরিক কর্মকর্তা ও গোয়েন্দা কর্মকর্তারা উর্দু ও ইংরেজিতে নিম্নোক্ত বিষয়ে তথ্য তার কাছ থেকে জানতে চাইতেন।

১। খুলনার জাতীয় পরিষদ, প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য, আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগ নেতৃবৃন্দ এবং কমিউনিস্ট আন্দোলনের সাথে সম্পৃক্তদের অবস্থান কোথায় হতে পারে?

২। খুলনায় বামপন্থী রাজনীতির সাথে জড়িতদের মধ্যে কে কে ভারত, চীন ও রাশিয়ার সমর্থক। বামপন্থীদের মধ্যে কোন অংশ মুক্তিযুদ্ধকে সমর্থন দিচ্ছে। পাকিস্তানি রাজনীতি এবং মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে চীন, রাশিয়ার মনোভাব কী?

৩। এই মুহূর্তে বামপšিদের রাজনীতি ও রণকৌশল কী?

৪। একাত্তরের ২৬ মার্চ বৈকালি এলাকা এবং ৪ এপ্রিল গল্লামারী এলাকায় পাকিস্তানিদের সাথে যুদ্ধে অংশগ্রহণকারীদের পরিচয় কী?

৫। খুলনার স্থানীয় সাপ্তাহিকগুলোর মধ্যে কারা পাকিস্তানের অখ-তা রক্ষার পক্ষে, কারা বিপক্ষে।

মাঝে মধ্যে বুট পরা অবস্থায় সেনা কর্মকর্তারা পা দিয়ে তাকে আঘাত করত। কিল, চড়, ঘুসি ও লাঠি দিয়ে প্রহার করত। তার শরীরের বিভিন্ন স্থান ক্ষত চিহ্ন দৃশ্যমান হয়। জিজ্ঞাসাবাদ ও নির্যাতনের কারণে তিনি জ্ঞান হারিয়ে ফেলতেন। বাইরের কোনো খবরা খবর জানার সুযোগ তার ছিল না। একাত্তরের ২৭ আগস্ট যশোর সেনানিবাস থেকে তাকে মুক্তি দেওয়া হয়। এ চার মাসে পরিবারের পক্ষ থেকে তার জন্য খাবার, ওষুধ, ফল ও পোশাকাদি সরবরাহ করা হলেও পাকিস্তানি সেনারা তা আত্মসাৎ করত। সেপ্টেম্বর থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত ময়লাপোতার বাসায় থেকে চিকিৎসাসেবা গ্রহণ করতেন।

স্বাধীনতা পরবর্তী শান্তিধাম মোড় থেকে তার সম্পাদনায় স্বরলিপি নামে পত্রিকা প্রকাশিত হতো। পত্রিকাটি প্রকাশনা ছিল দুমাস পর পর। পাকিস্তান জমানায় তার সম্পাদনায় যশোর থেকে ইশারা ও প্রান্তিক নামে অনিয়মিত পত্রিকা প্রকাশ পায়। তার অনন্য সৃষ্টি ১৯৭২ সালে গড়ে ওঠা শিশু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ময়লাপোতা মোড়ের স্কুল অব মিউজিক।

১৯৩১ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর তার জন্ম এবং ১৯৭৫ সালের ২২ মে মৃত্যু। বাগেরহাট মহকুমার ফকিরহাট থানার সৈয়দ মহল্লায় তার জন্ম। আব্দুল হক খান তার পিতা। তার উত্তারাধিকারী শেরে বাংলা রোডস্থ উত্তরণ প্রেসের মালিক তিশা আব্দুল হক খান।

সুন্দরবন আদর্শ মহাবিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক অধ্যাপক সুশান্ত সরকার ‘ভুলি কেমনে’ নামক এক প্রবন্ধে উল্লেখ করেন আজীজ খানের সম্পাদনায় বিদ্যুৎ কান্তি সরকারের আঁকা প্রচ্ছদে স্মরলিপি নামক সাহিত্য পত্রিকা তখন বাংলাদেশের প্রতিনিধি স্থানীয়। এই পত্রিকায় আজীজ খান বাংলা সাহিত্যে বিষয়বস্তুর সমস্যা নামক ধারাবাহিক প্রবন্ধ লিখে জনমত সৃষ্টি করেন। পত্রিকাটিও জনপ্রিয় হয়ে উঠে।

ভাষা সৈনিক ডা. আব্দুল মানাফ ব্যক্তিগত পরিবারের আলোকে আজীজ খান নামক প্রবন্ধে লিখেছেন তার স্মৃতি রক্ষার্থে কোনো মূর্তি, বা ছবি টানানোর প্রয়োজন হবে না। রাস্তার নামকরণ দরকার নেই। স্কুল অব মিউজিক আজীজ খানের শ্রেষ্ঠ স্মৃতিসৌধ।

 

খুলনা গেজেট/এনএম




আরও সংবাদ

খুলনা গেজেটের app পেতে ক্লিক করুন